১৪টি দেশ থেকে শ্রমিকরা মালয়েশিয়ায় যেতে পারলেও বাংলাদেশের ক্ষেত্রে কেন সমস্যা হয়েছে- তা সরকার খতিয়ে দেখছে বলে সংসদকে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারে অরাজকতা সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে। বাংলাদেশি কর্মী যেতে না পারার বিষয়টি অনুসন্ধান করা হচ্ছে।
৫ জুন, বুধবার জাতীয় সংসদে প্রশ্ন উত্তর পর্বে বিরোধীদলের চিফ হুইপ মুজিবুল হক চুন্নুর প্রশ্নের জবাবে তিনি এ কথা বলেন। এসময় অধিবেশনের সভাপতিত্ব করেন স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী।
মালয়েশিয়া শ্রমিক পাঠানোর ক্ষেত্রে কেন এত মানুষ বিড়ম্বনায় পড়ল প্রশ্ন রেখে প্রধানমন্ত্রী বলেন, যখনই সব ঠিক করা হয়, লোক পাঠানোর জন্য তখনই দেশের ও মালয়েশিয়ার এক শ্রেণির ম্যানপাওয়ার ব্যবসায়ী তড়িঘড়ির চেষ্টা করে। ফলে জটিলতা ও অস্বাভাবিক পরিস্থিতি তৈরি হয়। অনেক ক্ষেত্রে তাদের চাকরি ও কর্ম কিছুই ঠিক থাকে না। কিন্তু এবারেরটি অনুসন্ধান করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, সরকার আইন, সুযোগ-সুবিধা তৈরি করার পরও কেউ কেউ দালাল ধরে যান। কিছু মানুষ আছে, দ্রুত তড়িঘড়ি করে যেতে চায়। নিয়ম মানতে চান না।
আওয়ামী লীগের সদস্য খসরু চৌধুরীর এক লিখিত প্রশ্নের উত্তরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জানান, স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের পর কিছু অভিঘাত বিশেষ করে বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও স্বল্প সুদে ঋণ পাওয়ার ক্ষেত্রে কিছু সুবিধার অবসান ঘটবে। একই সাথে অর্থনৈতিক সক্ষমতার বিকাশের মাধ্যমে কিছু বাড়তি সুবিধা তৈরি হবে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশ ২০২৬ সালে স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে উত্তীর্ণ হয়ে উন্নয়নশীল দেশের তালিকাভুক্ত হবে। এটি নিশ্চিতভাবে স্বাধীনতা পরবর্তীকালে বাংলাদেশের জন্য অন্যতম উল্লেখযোগ্য অর্জন। এলডিসি থেকে উত্তীর্ণ পরবর্তী কিছু অভিঘাত বিশেষ করে বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও স্বল্প সুদে ঋণ পাওয়ার ক্ষেত্রে কিছু সুবিধার অবসান ঘটবে। অপরদিকে একই সাথে অর্থনৈতিক সক্ষমতার বিকাশের মাধ্যমে কিছু বাড়তি সুবিধা পাওয়ার সুযোগ তৈরি হবে।
তিনি বলেন, স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বেরিয়ে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদায় উন্নীত হওয়ার বিষয়টি মাথায় রেখে সরকার রূপকল্প-২০৪১ এবং এ সংশ্লিষ্ট প্রেক্ষিত পরিকল্পনা-২০৪১ গ্রহণ করে, যেখানে ২০৩১ এর মধ্যে উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়া, চরম দারিদ্র্য দূর করা এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উচ্চ আয়ের দেশের মর্যাদা লাভের পথনকশা নির্ধারণ করেছে। রূপকল্প ২০৪১ তথা প্রেক্ষিত পরিকল্পনা, ২০২১-২০৪১ মোট চারটি পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা হবে, যার প্রথমটি হলো ৮ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা। ৭ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার সফল বাস্তবায়ন শেষে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীতে এবং স্বাধীনতার সূবর্ণজয়ন্তীর প্রাক্কালে সরকার ‘৮ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা (জুলাই ২০২০-জুন ২০২৫)’ গ্রহণ করা হয়েছে। এ পরিকল্পনা প্রণয়নে বাংলাদেশ ব-দ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০-এর মূল লক্ষ্যসমূহ, টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (এসডিজি), চতুর্থ শিল্প বিপ্লব, স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের চ্যালেঞ্জসমূহকে বিবেচনায় নেয়া হয়েছে।
কোভিড-১৯ মহামারির কারণে সৃষ্ট চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ৮ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় কতিপয় কার্যকরী কৌশলেরও সুপারিশ করা হয়েছে। টেকসই উন্নয়ন অভীষ্টকে ধারণ করে দারিদ্র্য নিরসনে প্রণীত মধ্যমেয়াদি এ পরিকল্পনার মূলমন্ত্র হলো, ‘সকলের সাথে সমৃদ্ধির পথে’। ৮ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় যে মূল বিষয়সমূহের ওপর গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে, তা হলো, ত্বরান্বিত সমৃদ্ধি এবং সর্বাধিক কর্মসংস্থান সৃষ্টি, অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি, উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি ও দারিদ্র্য হ্রাস করা, একদিকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণজনিত চ্যালেঞ্জ অন্যদিকে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার সম্ভাবনা বিবেচনায় সরকার বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানমুখী অবকাঠামো উন্নয়ন, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিজ্ঞানসম্পন্ন মানবসম্পদ গড়ে তোলা এবং প্রতিবন্ধি ও বয়স্ক জনগোষ্ঠীর টেকসই সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা গড়ে তোলার লক্ষ্যে কার্যকর রাজস্ব ও মুদ্রানীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী আরো বলেন, এ কার্যক্রমের মাধ্যমে রাজস্ব আহরণের পরিমাণ বৃদ্ধি, কর-জিডিপি অনুপাত বৃদ্ধি, প্রবাসী আয় প্রেরণের হার বৃদ্ধি, রফতানি আয় বৃদ্ধির ধারা অব্যাহত রাখার জন্য রফতানি পণ্য ও রফতানি গন্তব্যস্থান বহুমুখীকরণ, বিদ্যমান গন্তব্যে রফতানির পরিমাণ বৃদ্ধির প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। পাশাপাশি সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগ আহরণের জন্য স্বয়ংসম্পূর অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তুলেছে। এলডিসি উত্তরণ পরবর্তী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার প্রস্তুতি হিসেবে এখন থেকেই বিভিন্ন দেশ ও আঞ্চলিক বিশ সহযোগিতা সংস্থাগুলোর সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) এবং অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য চুক্তি বা প্রেফারেন্সিয়াল ট্রেড অ্যাগ্রিমেন্ট (পিটিএ) এবং দ্বৈত কর পরিহার চুক্তি ত্বরান্বিত করার বিষয়ে গুরুত্বারোপ করছে। এছাড়া বৈশ্বিক বাণিজ্য ব্যবস্থায় বাংলাদেশের অবস্থান সুদৃঢ় করতে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (ডাব্লিউটিও), আঙ্কটাড, ইউএনডিপিসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।
ঢাকা-১৪ আসনের সংসদ সদস্য মো. মাইনুল হোসেন খানের প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, প্রত্যন্ত গ্রামের সাধারণ মানুষদের নাগালের মধ্যে কমিউনিটিবেজড স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে সারাদেশে কমিউনিটি ক্লিনিক নির্মাণ করেছে শেখ হাসিনা সরকার। শেখ হাসিনা সরকারের আমলে শুরু হওয়া এ কার্যক্রমের মধ্যে ৯৯টি কমিউনিটি ক্লিনিক এরই মধ্যে ধ্বংস হয়ে গেছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, কমিউনিটি ক্লিনিক বর্তমান সরকারের সাফল্যের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। এ কার্যক্রমের মাধ্যমে দেশের দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিত গ্রামীণ জনগণের কাছে কমিউনিটি ক্লিনিক থেকে সমন্বিত স্বাস্থ্য, পরিবার পরিকল্পনা ও পুষ্টি সেবা পাচ্ছেন। এটি জনগণ ও সরকারের যৌথ প্রয়াসে বাস্তবায়িত একটি কার্যক্রম। জনমুখী এ কার্যক্রম ১৯৯৬ সালে গৃহীত হয়, যার বাস্তবায়ন শুরু হয় ১৯৯৮ সালে। ১৯৯৮-২০০১ সময়ে ১০ হাজারেরও বেশি কমিউনিটি ক্লিনিক নির্মিত ও অধিকাংশই চালু করা হয় এবং জনগণ সেবা পেতে শুরু করে। কিন্তু ২০০১ সালে সরকার পরিবর্তনের পর এ কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায় এবং এ অবস্থা ২০০৮ সাল পর্যন্ত চলমান থাকে। দীর্ঘদিন অব্যবহৃত থাকায় নদীভাঙন ও অন্যান্য কারণে ৯৯টি কমিউনিটি ক্লিনিক ধ্বংস হয়ে যায় এবং ১০ হাজার ৬২৪টি বিদ্যমান থাকে।
শেখ হাসিনা বলেন, ২০০৯ সাল থেকে ‘রেভিটালাইজেশন অব কমিউনিটিজ হেলথ কেয়ার ইনিশিয়েটিভ ইন বাংলাদেশ (আরসিএইচসিআইবি)’ প্রকল্পের মাধ্যমে কমিউনিটি ক্লিনিক পুনরুজ্জীবিতকরণ কার্যক্রম শুরু হয়। এ কার্যক্রমের মাধ্যমে ১৯৯৮ থেকে ২০০১ সময়ে নির্মিত কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোর প্রয়োজনীয় মেরামত, জনবল পদায়ন,ওষুধ ও প্রয়োজনীয় সামগ্রী সরবরাহপূর্বক নতুন নির্মিত কমিউনিটি ক্লিনিক পর্যায়ক্রমে চালু করা হয়। পরবর্তীতে কমিউনিটি ক্লিনিক কার্যক্রম পরিচালনার লক্ষ্যে চতুর্থ সেক্টর (৪র্থ এইচপিএনএসপি) অপারেশনাল প্ল্যান অন্তর্ভুক্ত করা হয়। বর্তমানে কমিউনিটি ক্লিনিক স্বাস্থ্য সহায়তা ট্রাস্টের আওতায় কমিউনিটিবেজড হেলথ কেয়ার (সিবিএইচসি) এর মাধ্যমে কমিউনিটি ক্লিনিকের সমস্ত কার্যক্রম বাস্তবায়িত হচ্ছে। সারাদেশে বর্তমানে ১৪ হাজার ২৯২টি কমিউনিটি ক্লিনিক নির্মাণ সম্পন্ন হয়েছে। এর মধ্যে মোট ১৪ হাজার ২৭৫টি কমিউনিটি ক্লিনিক চালু রয়েছে এবং ৯৮টি কমিউনিটি ক্লিনিকের নির্মাণ কাজ চলমান রয়েছে।
সরকার প্রধান বলেন, কমিউনিটি ক্লিনিক থেকে গ্রামীণ জনগণকে মূলত স্বাস্থ্য শিক্ষা, স্বাস্থ্য উন্নয়ন, পুষ্টি, পরিবার পরিকল্পনা, উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস রোগ শনাক্তকরণ, সীমিত নিরাময়মূলক সেবাসহ জরুরি ও জটিল রোগীদের যথাযথ ব্যবস্থাপনার জন্য উচ্চতর পর্যায়ে রেফার সংক্রান্ত সেবা দেওয়া হচ্ছে। এছাড়া অসংক্রামক রোগসমূহ প্রাথমিকভাবে নিরূপণ এবং উচ্চতর পর্যায়ে রেফার যেমন- উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, আর্সেনিকোসিস, অটিজম ইত্যাদি কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। অসংক্রামক রোগ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে কমিউনিটি ক্লিনিকে নিয়মিত স্বাস্থ্য শিক্ষা কার্যক্রম আরো জোরদার করা এবং একটি কার্যকর রেফারেল ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে।
এদিকে সংসদীয় আসন শূন্য ঘোষণা না হওয়ায় ঝিনাইদহের সংসদ সদস্য (এমপি) আনোয়ারুল আজিমের শোক প্রস্তাব সংসদে উপস্থাপন হয়নি।
স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে বুধবার বসে দ্বাদশ জাতীয় সংসদের তৃতীয় এবং নতুন সরকারের প্রথম বাজেট অধিবেশন। বৈঠকের শুরুতে তিনজন সাবেক সংসদ সদস্যের মৃত্যুতে শোক প্রস্তাব পাঠ করেন স্পিকার শিরীন শারমিন। বহুল আলোচিত ঝিনাইদহের এমপি আনোয়ারুল আজিমের সংসদীয় আসন শূন্য ঘোষণা না হওয়ায় শোক প্রস্তাবে ছিল না তার নাম।
রেওয়াজ অনুযায়ী জাতীয় সংসদের বুধবারের অধিবেশনের প্রথম ৩০ মিনিট ছিল প্রধানমন্ত্রীর প্রশ্নোত্তরের জন্য। সরকারি এবং বিরোধী ও সংসদ সদস্যদের প্রশ্নের উত্তর দেন সংসদ নেতা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
দ্বাদশ সংসদের তৃতীয় অধিবেশনের বৈঠকের শুরুতে প্যানেল স্পিকারের নাম ঘোষণা করেন স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী।